পাকুন্দিয়া উপজেলার সব সংবাদসহ, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলার সংবাদ দেখতে ক্লিক করুন => Pakundiapratidin.news ** আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া সকল সংবাদ আমাদের জানাতে পেইজে মেসেজ দিন অথবা হোয়াটস্অ্যাপে যোগাযোগ করুন- 01683130971 ** যে কোনো বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন- 01401300029 অথবা 01303405500 **

বারবার অনুরোধেও সেই গোরখোদককে ঘোড়া উপহার দিতে পারলেন না বাসার




 গোরখোদক মনু মিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী ঘোড়াটিকে কে বা কারা মেরে ফেলেছে। ৩ হাজার ৫৭টি কবর খোঁড়া মনু মিয়াকে নিয়ে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন দেখে অভিনেতা খায়রুল বাসার ছুটে যান তাঁকে দেখতে। গতকাল ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁদের দীর্ঘ সময় কথা হয়। মনু মিয়ার কথায় বাসারের মনে হয়েছে, ‘তাঁরা সমাজের নায়ক।’


মনু মিয়া ও বাসার—দুজনই কিশোরগঞ্জের মানুষ। শুরুতেই মজা করে বাসার প্রশ্ন করেন, ‘আপনি মনু মিয়ার কী হন?’ শুনে মনু মিয়াও সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘আরে ফাগল, আমিই তো মনু মিয়া।’ পরে তাঁদের আড্ডা জমতে আর সময় লাগে না। বাসারের মনে হয়েছে, মনু মিয়া বয়স অনুযায়ী বেশ শক্ত। মানসিকভাবেও দৃঢ়চেতা। এ ধরনের মানুষ সহজেই ভেঙেন পড়েন না। তবে কথার এক পর্যায়ে মনু মিয়া ‘হতাশ’ করেন এই অভিনেতাকে। সেটাও বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেন এই অভিনেতা।



বাসার বলেন, ‘তিনি তিন হাজারের বেশি কবর খুঁড়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেছেন নিজের ঘোড়া। সেই ঘোড়াটিকে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলার কথা শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমরা একই অঞ্চলের ভাটির মানুষ। আমাদের আঞ্চলিক ভাষা এক। কথার এক পর্যায়ে তাঁকে বলি, “একটি ঘোড়া আপনাকে কিনে দিতে চাই।” কিন্তু তিনি ঘোড়া নিতে চান না। কোনোভাবেই তাঁকে রাজি করাতে পারিনি; বরং তিনি বারবার এটাই জানিয়েছেন, সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে সাতটা ঘোড়া কিনতে পারবেন।’


মনু মিয়া ঘোড়া মারা যাওয়ার কথা শুনে আহত হননি। এতেও অবাক হয়েছেন এই অভিনেতা। বাসার জানান, ঘোড়া মারা যাওয়া নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো দুঃখবোধ নেই। তিনি মনে করেন, তাঁর আছে বলেই গেছে। যাঁর আছে, তাঁর যায়। এতে কষ্ট হচ্ছে না। বাসার বলেন, ‘আমি জানতে চেয়েছিলাম, দীর্ঘদিনের ঘোড়াটি নিয়েই সব জায়গায় যেতেন, কেউ মেরে ফেলল, আপনার কোনো কষ্ট হচ্ছে না? তাঁর কথা শুনে অবাক হয়েছি। তিনি বললেন, “কপালে লেখা ছিল। কষ্ট হচ্ছে না। আমার কেউ ক্ষতিও করেনি। এটা অমানুষও করেনি। ঘোড়াটি এই পর্যন্তই আমার সঙ্গে থাকবে, সেটা ভাগ্যে লেখা ছিল। কে মেরেছে, আমি নিজ চোখে দেখিনি, কাকে দোষ দেব। ধান পেকে গেলে কাটতে হয়, এটাও আমার কাছে তেমনই ঘটনা।”’


বাসার জানান, এই মনু মিয়ার সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বুঝতে পেরেছেন, তিনি কারও অনুদান নিতে চান না। সাধ্যের মধ্যেও অনেক কষ্টে তিনি ঘোড়া কিনেছেন। তিনি কোনো দিন কারও কোনো ক্ষতি করেননি। মনু মিয়ার জীবনযাপন তাঁকে মুগ্ধ করেছে।

তাঁর মধ্যে আলাদা একটা জীবনবোধ রয়েছে। নিজস্ব দর্শনকেই তিনি প্রাধান্য দেন। তিনি যে শৌখিন মানুষ, সেটা বোঝার বাকি ছিল না। শখের পেছনে তাঁর কয়েক লাখ টাকা ব্যয়। তাঁর দামি চাবুক রয়েছে। যদিও তিনি কখনোই ঘোড়াকে মারেন না। হাতির দাঁত দিয়ে ছুরি টাইপের কিছু বানিয়েছেন। হরিণের শিংয়ের লাঠি তাঁর কাছে আছে। এর মধ্যে একটির দাম নাকি লাখ টাকার বেশি। তিনি সম্পত্তি বিক্রি করেই শখ মিটিয়েছেন, বললেন বাসার।


তবে ঘোড়ার জন্য মনু মিয়ার মন খারাপ হয়েছিল, সেটা বাসার বুঝতে পারেন। ঘোড়াপ্রেমী এই মনু ১০ মণ ধানের কুঁড়া, ১০ মণ খড় কিনেছিলেন ঘোড়ার খাবারের জন্য। বাসার বলেন, ‘কথা বলতে গিয়ে একসময় তিনি চুপ ছিলেন। পরে বলতে থাকেন, ‘‘আমি অসুস্থ হয়ে ঢাকায়, এখানে শুনি ঘোড়াটা মারা গেছে। আমার চেয়ে আমার পরিবারের লোকদেরও অনেক কষ্ট হচ্ছে। পরিবারের লোকেরা ঘোড়াকে পালে। আমি তো ঢাকায়, বাড়িতে গেলে কান্না পাবে।” আমি তাঁকে আবার বললাম ঘোড়া কিনে দেওয়ার কথা, তিনি রাজি নন। তিনি বাড়ি যেতে পারলে নিজেই আবার শখ মেটাবেন।’


বর্তমানে মনু মিয়া ডায়াবেটিস ও কোমরব্যথা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি এই অভিনেতাকে জানান, তাঁর কোনো শত্রু নেই। তিনিও কখনো মনে করেন না, কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারেন। তিনি সবাইকে আপন মনে করেন। এ জন্যই তিনি ছুটে যান সবার কবর খুঁড়তে। বাসার বলেন, তিনি অসুস্থ হয়েছেন অনিয়মের জন্য। যদি রাতে খাওয়ার পর শোনেন কাল কোথাও কবর খুঁড়তে যেতে হবে, পরে তিনি আর কিছুই খেতে পারেন না। পরের দিন কবর দেওয়া শেষ হলে সন্ধ্যায় এসে বাড়িতে খান। মৃত্যুবাড়িতে তিনি কিছু খান না। এমনকি কোনো টাকাও কোনো দিন নেন না। খাবারের অনিয়ম করেন। মানুষের পাশে থাকাটাই তাঁর কাছে প্রথম।



বাসার আরও বলেন, ‘মনু মিয়ার কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে চান না। বললেন, ‘‘ভাতিজা, দোয়া কইরো। আমি যেন আবার কাজে ফিরতে পারি। সুস্থ হয়ে মরতে চাই। আমার দুশমনও যেন হাসপাতালে না আসে।” কেউ তাঁর ক্ষতি করলেও তিনি বিচার চান না। ধরে নেন, ভাগ্যে লেখা ছিল। তাঁকে জানিয়েছি, প্রায় ১০০ জন তাঁকে ঘোড়া দিতে চায়, সেটা নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না। এমনকি সবাই যদি টাকাও দেন, সেটাও নিতে চান না। সবশেষে কান্না করে বললেন, তাঁর শুধু একটাই শখ, হজে যাওয়া। সেটাও নিজের মতো করেই যেতে চান।’


বাসারের নিজের উপলব্ধি, মনু মিয়ারাই সমাজের নায়ক। যাঁদের অন্তরের চোখ দিয়ে দেখা যায়, উপলব্ধি করা যায়। অভিনেতা বলেন, ‘এমন মানুষের কথা শুনলে জটিলতায় ভরা দুনিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে আলাদা দায় অনুভব করেন। যা আমাদের এই সমাজে সবার জন্য অনুসরণীয়। মনু মিয়াই আমাদের এক উজ্জ্বল আদর্শ হয়ে উঠেছেন। মনু মিয়া নায়ক হতে চাননি। তাঁর মহৎ কাজ তাঁকে আমাদের নায়ক করে তুলেছে। এই দিশাহীন সমাজে তাঁর মতো খাঁটি সোনার মানুষের অভাব।’

সূত্র-প্রথম আলো

Post a Comment

Previous Post Next Post