উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যেতে চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের আলুকান্দা গ্রামের আরমান মিয়া (৩২)। পূর্বপরিচিত দালাল জসিম উদ্দিনের প্রলোভনে জমি ও নগদ মিলিয়ে ৩০ লাখ টাকার চুক্তিতে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ৭ নভেম্বর দেশ ছাড়েন তিনি। দালাল প্রথমে আরমানের পরিবারকে ইতালি পৌঁছানোর ‘সুখবর’ দিলেও পরে জানান, ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এরপর আরমানের খোঁজ মিলছিল না। ১১ দিন পর হঠাৎ দালাল ফোন করে জানান, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে আরমান মারা গেছেন।
আরমানের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর থেকে গ্রামের বাড়িতে মাতম চলছে। পরিবারের সদস্যরা জানান, দালাল জসিম উদ্দিন ফোন করে জানিয়েছেন, লিবিয়া থেকে গতকাল সোমবার সাগরপথে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে আরমানের মৃত্যু হয়েছে। এই কথা বলে ফোন কেটে দেন। লাশ উদ্ধার হয়েছে কি না, সে বিষয়েও তথ্য দিতে পারেননি। এ নিয়ে হইচই করতেও নিষেধ করেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ভৈরবের আলুকান্দা গ্রামের আরমানদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনেরা আহাজারি করছেন। আরমানের মৃত্যুর খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন বাড়িতে ভিড় করছেন।
আরমানের ছোট ভাই নয়ন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না, আমার ভাই নৌকাডুবে মারা গেছে। আমার ভাইকে দালাল চক্র পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে থাকতে পারে। জসিম কয়েক দিন ধরে আমাদের বিভিন্ন কথা বলে বিভ্রান্ত করে আসছিল।’
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাত ভাই–বোনের মধ্যে আরমান তৃতীয়। তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তান রয়েছে। পাঁচ বছর মালয়েশিয়ায় থেকে কয়েক মাস আগে দেশে আসেন। আলুকান্দা গ্রামের পাশের ফাঁড়ি রঘুনাথপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন (৪৫) কয়েক বছর ধরে বিদেশে লোক পাঠান। তিনি নিজেও লিবিয়ায় থাকেন। জসিম তাঁকে ফোনে ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। লিবিয়া হয়ে সাগরপথে ইতালি পৌঁছে দিতে আরমানের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের সাত শতাংশ জমি লিখে নেওয়ার পাশাপাশি নগদ ১০ লাখ টাকা নেন। কথা ছিল আরমানকে বিশেষ নৌকায় ‘ঝুঁকিমুক্ত’ অবস্থায় ইতালি পৌঁছে দেবেন।
৭ নভেম্বর লিবিয়া পৌঁছান আরমান। তিন দিন আগে জসিম ফোন করে আরমানের পরিবারের সদস্যদের জানান, আরমান ইতালি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু পরদিন দুপুরে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানান, এখনো ইতালি যাননি আরমান। যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সবার দোয়াও চান। তখন জসিমের প্রতি স্বজনদের সন্দেহ হয়। পরে চেষ্টা করেও জসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় আজ সকালে জসিম ফোন করে জানান, গতকাল সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকা ডুবে আরমান মারা গেছেন। নৌকায় থাকা অন্যরাও মারা গেছেন। তবে তাঁরা কারা, সেটা তিনি জানাতে পারেননি।
এদিকে আরমানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর আরমানের পরিবারের সদস্যরা লিবিয়ায় পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আরমানের মৃত্যুর সংবাদ তাঁরাও শুনেছেন বলে জানান। তবে কীভাবে মারা গেছেন, কেউ বলতে পারছিলেন না।
আরমানের ভাই নূরে আলম বলেন, ‘আমার ভাই দেশ ছাড়ার পর থেকে জসিমের আচরণ সন্দেহ তৈরি করে। দুই দিন আগে বলেন, আরমান ইতালি পৌঁছে গেছে। দুই দিন পর আবার তাঁর মুখ থেকে শুনতে হয়েছে, আমার ভাই সাগর ডুবে মারা গেছে। এসবের মধ্যে অবশ্যই বড় কিন্তু আছে।’ একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
আরমানের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে দালাল জসিম উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি। সেখানে গিয়ে জসিমের মা হামিদা বেগমকে পাওয়া যায়। ১০ দিন আগে জসিমের স্ত্রী-সন্তান লিবিয়ায় চলে গেছেন। হামিদা বেগম বলেন, ‘আরমানের মৃত্যুর খবর ছেলে আমার কাছেও বলেছে। তবে আমি শুনেছি, সাগরে নাকি গোলাগুলি হয়েছে। গুলি লেগে আরমান মারা যায়।’ তাঁর ভাষ্য, বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে জসিমের স্ত্রী আকলিমা বেগমের সঙ্গে আরমানের লেনদেন হয়েছে।
ভৈরব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু তালেব বলেন, এমন কারও মৃত্যুর খবর পুলিশ এখনো পায়নি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিতভাবে তাদের জানাননি। জানতে চাইলে আরমানের ভাই নয়ন মিয়া বলেন, ‘সন্ধ্যার মধ্যে থানা-পুলিশকে আমরা লিখিতভাবে জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
-সূত্রঃ প্রথম আলো অনলাইন




