দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত শিক্ষা। আর এ খাতের উন্নয়নের কারিগর হলেন শিক্ষকরা। অথচ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন অপরিকল্পিত ব্যবস্থায় চলছে, তেমনি চরম অবহেলিত পাঠদানকারীরা। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গুরুদের বঞ্চনার যেন শেষ নেই। যে শিক্ষকদের ব্যস্ত থাকার কথা পাঠকক্ষে, অথচ একেকটা অধিকার আর সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য মাঝে মধ্যেই তাদের নামতে হয় রাজপথে।
কাঙ্ক্ষিত বেতন-ভাতা, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ন্যূনতম জীবন ধারণের দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় অনেক শিক্ষককে। এ কারণে তাদের মাধ্যমে মানসম্মত পাঠদান প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেউ কেউ আবার বাড়তি আয়ের জন্য প্রাইভেট-টিউশনি বা কোচিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। শিক্ষকদের এই দুরবস্থা দেখে নতুন করে এই পেশায় আসতে আগ্রহ হারাচ্ছেন মেধাবীরা। সব মিলিয়ে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদের যথাযথ মান ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
দেশের শিক্ষকদের এই দুরবস্থার মধ্যেই আজ রোববার পালিত হচ্ছে ‘৩১তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। ‘শিক্ষকতা পেশা : মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’-এই প্রতিপাদ্যে এবার সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হবে দিনটি। এ উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আজ সকাল ১০টায়
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ২০২৫ সালের জন্য মনোনীত গুণী শিক্ষকদের সম্মাননা দেওয়া হবে।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন। এছাড়া শিক্ষা খাতের অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতে উপস্থিত থাকবেন। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের দিবস পালন করা হলেও বাস্তবে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা নিয়ে অসন্তোষ কমছে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে জায়গায় থাকা দরকার তা নেই। কারণ, শিক্ষকদের নিয়ে সরকার যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে তাতে নানাক্ষেত্রে মান-মর্যাদা সমান নয়। শিক্ষকরা কোন পর্যায়ে যোগদান করবে, তাদের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা কি ধরনের হবে সেগুলো নির্ধারিত নেই। অনেকটা স্থবির একটা ক্ষেত্র এটা। শিক্ষকদের অনেকে একই পদে চাকরি জীবন শেষ করেন। বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে এই সমস্যা বেশি।
শিক্ষকদের মান প্রসঙ্গে এই শিক্ষাবিদ বলেন, বিশ্বে হয়তো একমাত্র দেশ হিসেবে এখানে শিক্ষক সংশ্লিষ্ট কোনো সার্টিফিকেট ছাড়াই নিয়োগ পাচ্ছেন। এতে মানসম্মত শিক্ষক পাচ্ছি না। তা ছাড়া বর্তমান বেতন কাঠামো ও স্ট্র্যাটেজিতে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আগ্রহী করা যাচ্ছে না। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকরা স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। শিক্ষকদের মর্যাদা তো নেই-ই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের অস্বস্তি কিছুটা কম হলেও সরকারি অন্য চাকরির তুলনায় ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করলে এই তুলনা কমবে। শিক্ষক ও শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য এ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করা, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি স্বাভাবিক করা এবং গবেষণার সুযোগ থাকতে হবে।
শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানে পরিকল্পিত একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সময়ে সময়ে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেমন সরকার শিক্ষকদের কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ করলেও তাদের মানসম্মত বেতন-ভাতা নিশ্চিত করেনি। আমরা শিক্ষকদের যথাযথ মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চাই। বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে ৭ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করা হবে।
জানা গেছে, দেশে শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকরা। এ বিষয়ে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সমন্বয়কারী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শেখ নজরুল ইসলাম মাহবুব বলেন, ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ হয়েছে, অথচ একটি ইবতেদায়ি মাদরাসাও সরকারীকরণ করা হয়নি। এই বৈষম্যের অবসান ঘটুক।
অবহেলিত আরেকটি খাত কওমি মাদরাসা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দুরবস্থা তুলে ধরে রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার শিক্ষক ও মিডিয়া বিভাগীয় প্রধান মুফতি মোস্তফা ওয়াদুদ বলেন, বেফাক নিবন্ধিত প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদরাসায় লক্ষাধিক শিক্ষক আছেন। শতভাগ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এসব মাদরাসার শিক্ষকরা স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও কম সুযোগ-সুবিধা পান। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রেও কওমি সনদধারীদের সমান সুযোগ রাখা দরকার।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব প্রিন্সিপাল দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, এমপিওভুক্ত প্রায় ৩০ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষক চরম বৈষম্যের শিকার। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা করলেও আমরা অর্ধেক বেতনও পাই না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়ও আমরা কম বেতন পাই।
তিনি বলেন, ইবতেদায়ি পর্যায়ে ৯ হাজার ৩০০ এবং স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকরা সাড়ে ১২ হাজার টাকা পান। দেশের বর্তমান বাজারের প্রেক্ষাপটে এই টাকা দিয়ে মাসের অর্ধেকও চলে না। বাকি সময় চলে দুশ্চিন্তায়। এ অবস্থায় মানসম্মত শিক্ষাদান কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন করেই অধিকার আদায় করতে হয়। কারণ, শিক্ষার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে শিক্ষকরা থাকেন না। শিক্ষকতায় আগ্রহ কমে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি এক লাখ শূন্য পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েও ৪০ হাজারও আবেদনও পাওয়া যায়নি।
স্বস্তিতে নেই সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরাও। স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠাসহ পাঁচ দফা দাবি আদায়ে নানা কর্মসূচি পালন করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তারা। তাদের দাবির মধ্যে আরো রয়েছে-সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষকের এন্ট্রিপদ নবম গ্রেডে উন্নীত করে চার স্তরীয় পদসোপান বাস্তবায়ন। অনতিবিলম্বে আঞ্চলিক উপপরিচালকের প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা সংরক্ষণসহ মাধ্যমিকের সব কার্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা রক্ষা। বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখার সব শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন এবং বকেয়া সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের মঞ্জুরি আদেশ দেওয়া।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির প্রধান সমন্বয়ক ও নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, আমাদের পদমর্যাদা ঠিক নেই। পদোন্নতির সুযোগ আছে মাত্র ৪ শতাংশ। মাউশিসহ বিভিন্ন পদে কলেজ শিক্ষকদের পদায়ন করা হচ্ছে, এতে বঞ্চিত হচ্ছেন মাধ্যমিক শিক্ষকরা। এমনিতেই সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক কম, তারপর যেটুকু পাওয়ার কথা সেটা থেকেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
শিক্ষক দিবসের আলোচনায় নানা দাবি
৩১তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর একটি মিলনায়তনে আলোচনা সভা করে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ। কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ ইসহাক হোসেনের সভাপতিত্বে এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন এহছানুল হক মিলন। মুখ্য আলোচক ছিলেন প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান।
এ সময় ড. আ ন এহছানুল হক মিলন বলেন, যদি জনগণের সমর্থন নিয়ে আমরা সরকার গঠন করতে পারি তবে শিক্ষাক্ষেত্রে সব বৈষম্য ও অব্যবস্থা দূর করা হবে। তিনি আরো বলেন, যেহেতু আদর্শ শিক্ষকরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান তাই তাদের প্রাপ্ত মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক মাজহারুল হান্নান বলেন, যেহেতু সরকার-বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ বেতন ও অন্যান্য ভাতা সরকারি কোষাগার থেকে প্রদান করেন সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন নেই। যে নিয়মে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়, সেভাবেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, যেসব শিক্ষক কর্মচারী অবসর গ্রহণ করেছেন তাদের প্রাপ্য টাকা অবিলম্বে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের অবিলম্বে এমপিওভুক্তি, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার বিষয়ে ২১ সালের কালাকানুন বাতিল, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবির কথা উল্লেখ করেন তিনি।
সূত্র মতে, প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বের ১০০টি দেশে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়।
-আমার দেশে অনলাইন